বৃহস্পতিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

ত্রিবর্গের প্রতিপত্তি

মানবজীবনের সর্বাপেক্ষা অপরিহার্য

প্রাচীনযুগের ইতিহাস পড়লে দেখা যায় তখন মানুষ সাধারণতঃ একশত বছর বাঁচত। প্রথম ষোল বছর বাল্য ও শৈশবকাল বিদ্যার্জনে ব্যয়িত হত তারপর আরম্ভ হত সংসার জীবন। সেটা চলত পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত। তারপর আসত বাণপ্রস্থ, শেষ জীবনে অর্থাৎ ষাটের ওপরে হত সন্ন্যাস। তখন ভগবানের ধ্যান-ধারণা করতে করতে শেষ জীবনটুকু কাটাতে তারা।

বাল্য ও কৈশোরে

বাল্য ও কৈশোরে ছেলেরা প্রথম অভিভাবদের অধীন থেকে বিদ্যাশিক্ষা করত তারপর তারা যেত গুরুগৃহে। গুরুগৃহে থেকে তারা অঙ্কন বিদ্যা, গণিত শাস্ত্র, শিল্পকলা, সাহিত্য, ব্যাকরণ, ন্যায়, বাণিজ্য প্রভৃতিতে জ্ঞানলাভ করত আর ষোল বছর বয়েস পার হয়ে গেলে গুরুগৃহের পাঠ শেষ করে ফিরত তখন কেউ বা বিবাহ করত, কেউ বা করত না।

যৌবনে

গুরুগৃহে যে বিদ্যা অর্জন করত তার অনুশীলন করে তারপর তারা নানা শিল্প, বাণিজ্য, কাব্য, সাহিত্য, ব্যবসায় ইত্যাদি নানাভাবে অর্থ উপার্জনের চেষ্ট করত সঙ্গে সঙ্গে যৌবন আগমণে তাদের মধ্যে কামবৃত্তি স্ফুরিত হওয়ায় তারা হয় বিবাহের পর স্ত্রীসঙ্গ করত আর তা না হলে সুন্দরী কলাবিদ্যা নিপুণা নারীদের সঙ্গ লাভ করত তাছাড়া নানা প্রকার জীবন আনন্দকর উৎসবে যোগদান করে সঙ্গীত, নৃত্য, বাদ্য ইত্যাদিতে পারদর্শিতা লাভ করে জীবনটাকে পরম সুখে অতিবাহিত করার চেষ্টা করত

তখনকার দিনে বহু নারীকে বিবাহ করা এবং বহু নারীকে একসঙ্গে সম্ভোগ করা অসামাজিক ও নিন্দনীয় বলে পরিগণিত হত না, সেটা ছিল সামাজিক রীতি। এমন কি কোন ভদ্রসন্তান বা অভিজাত বংশের লোক যদি পতিতা সম্ভোগ করত, তখনকার দিনে তা পাপ বলে লোকে মনে করত না, তাদের দুশ্চরিত্র অপবাদ দেওয়া হত না।

বারনারী বা পতিতারা শিল্পবিদ্যা, সঙ্গীতবিদ্যা, বাদ্যযন্ত্র প্রভৃতিতে বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করত শূদ্রক রাজার রচিত মৃচ্ছকটিকনাটকে সে আমলের এক অপূর্ব চিত্র পাওয়া যায়। এটি কবি কালিদাসের বা বাৎস্যায়নের সমসাময়িক কালেই রচিত। এই নাটকে দেখা যায় চারুদত্ত নামে একজন সম্ভ্রান্ত ও উচ্চ শিক্ষিত ব্যাক্তি বসন্তসেনা নামে এক বারাঙ্গনার জন্য শূলে মৃত্যু পর্যন্ত বরণ করতে গিয়েছিল। তখনকার দিনে কি যুবক, কি যুবতী সবাই যৌবন মদে মত্ত হয়ে পরস্পর উল্লাস, কাম ও যৌন আনন্দ ইত্যাদি সম্ভোগ করত।

কামশাস্ত্র ও ধর্ম

যুবক বা যুবতীরা সংসার ধর্ম পালন করতে বা যৌবন মদে মত্ত হয়ে যে হিন্দু শাস্ত্রের বিধি নিষেধগুলি অবজ্ঞা করত তা কখনও নয়। পুরুষেরা দেখত, নারীর সঙ্গে পূর্ণ বিলাস, পূর্ণ কামচর্চা করলে তাতে কোন ধর্মশাস্ত্র ব্যবস্থা লঙ্ঘন করা হয় না। বরং যে কোন নায়িকা অধিকাংশ স্থানে ধর্মকার্যে বা সৎপথে নায়ককে চলতে প্ররোচিত করত তখনকার দিনে ব্রাহ্মণদিগের কর্তব্য ছিল-

ইষ্যাধ্যয়ন দানামিং তপঃ শান্তিং ধৃতিঃ ক্ষমা।
অলোভ ইতি অষ্টানি ব্রাহ্মণানাৎ!

-মনুসংহিতা

অর্থাৎ, ব্রাহ্মণদের কর্তব্য ছিল যজ্ঞ, পড়াশুনা, দান, তপস্যা, ক্ষমা, সহ্যগুণ বা ধৃতি প্রভৃতি। ক্ষত্রিয়দের কর্তব্য ছিল প্রজাদিগের রক্ষা, যুদ্ধ বিগ্রহ, যজ্ঞকার্যের উদ্যোগ প্রভৃতি। বৈশ্যদের কর্তব্য ছিল বাণিজ্য, অর্থ উপার্জন আর শূদ্রদের কর্তব্য ছিল অন্য জাতিদের সেবা।

এই সব কাজে নারী পুরষদের উৎসাহ দিত এবং কামচর্চা করতে করতে তারা প্রিয় বংশবদ পুরুষকেও সৎ উদ্দীপনায় প্ররোচিত করত নারীর ধর্ম ছিল স্বামী, স্বামীর ধর্মই নারীর ধর্ম বলে গণ্য হত তাই স্ত্রীর নাম ছিল সহধর্মিণী।

অর্থ ও কাম

বাৎস্যায়ন বলেন যত কামে উন্মত্ত হবে তত অর্থ উপার্জন করার প্রবৃত্তি ও কৌশল সৃষ্টি করতে পারবে, তার অর্থ উপার্জন তত বাড়বে। তার কেবলই ইচ্ছা হবে কিসে বেশি অর্থ উপার্জন করে সে স্ত্রী পরিনীতা বা অভীপ্সীতা বা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ নারীকে উজ্জ্বল মণিমাণিক্যাদি কচিত অলংকার দিয়ে তৃপ্ত করতে পারবে তার সঙ্গে প্রেমানন্দ তত বৃদ্ধি পাবে। নায়িকা এতে তৃপ্ত হবে, তাই সে পুরুষকে সুখপূর্ণ আলিঙ্গন, চুম্বন, সুরত ইত্যাদি দ্বারা তার জীবনকে স্বর্গতুল্য করে তুলবে। জীবন হবে সুখপূর্ণ, জীবন হবে প্রকৃতই আনন্দময় ও তৃপ্তিকর।

এইভাবে বাৎস্যায়নের মত, কাম এবং কাম পরিতৃপ্তিই মানুষকে ধর্ম ও অর্থ উপার্জনের পথে নিয়ে যায়। কামই মানুষকে সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের পথে এগিয়ে যাবার ক্ষমতা দেয়। কামই জীবনের পথকে প্রকৃতই সুগম্য ও কুসুমে ত্তীর্ণ করে তোলে।