বৃহস্পতিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

সাধারণ কথা

কামসূত্রের উৎপত্তি ও বিকাশ

আমাদের দেশের প্রাচীন শাস্ত্রপাঠে জানা যায় যে, খ্রীষ্টের জন্মের শত শত বছর আগেও ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিরাট উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত ছিল সেই প্রাচীন দিনে বিশ্বের বিভিন্ন জাতি আত্মিক উন্নতি, সামাজিক ও বৈষয়িক ধ্যানজ্ঞান সব কিছুর সার্থক সাধনার জন্যই ভারতের শাস্ত্রের দিকে দৃষ্টিপাত করতেন। সে ছিল একটা স্বর্ণ যুগ, একটি অতুলনীয় যুগ। একদিকে বেদ, উপনিষদ, প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থ, অন্য দিকে বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিষয় নিয়ে সার্থক সব গ্রন্থ রচিত হয়েছিল মানুষ যাতে ধর্মীয়ভাবে জীবনযাপন করতে পারেন তাই তাঁদের জীবনে চারটি সাধনের স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়, তা হল ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ।

মানুষের সমস্ত কাজের পেছনে চাই অর্থ। চারটি সাধনের স্পষ্ট সাহচর্য দেখা যেত মানুষের জীবনযাত্রাকে নিয়ন্ত্রিত করার জন্যে বিভিন্ন অংশে ভাগ করা হত তা হল ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বাণপ্রস্থ ও সন্ন্যাস। তাই দেখা যাচ্ছে সাধনার মধ্যে ধর্মের পর অর্থ, তারপরই কাম, ছাত্র জীবনে বা ব্রহ্মচর্যের পরই গার্হস্থ্য বা দাম্পত্য জীবন স্থান পেয়েছে।

কামশাস্ত্র আলোচনার স্তর

পুরাণ মতে ব্রহ্ম বা পূর্ণব্রহ্ম সারা বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞান নানা ঋষি বা মুনির মাধ্যমে প্রকাশ ও প্রচার করে থাকেন। তাই ঋষি বা মুনিদের প্রাচীন ভারতে বিরাট একটা সম্মানের আসন দেওয়া হত

এই মত অনুযায়ী নর-নারীদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সমস্ত বিধান রচনা করেন মনু, যাঁকে ভারতীয় আইন শাস্ত্রের পিতা বলা হয়ে থাকে। তারপর বৃহস্পতি রচনা করেন অর্থশাস্ত্র। মহাদেবের অনুচর নন্দী হর পার্বতীর কথোপকথন শুনে রচনা করেন রতিশাস্ত্র, গ্রন্থের নাম মনুসংহিতা। মহর্ষি উদ্দালিকের পুত্র শ্বেতকেতু তা থেকে একটি সুন্দর প্রন্থ রচনা করেন। তাপর বাভ্রব্য নামে উত্তর ভারতের একজন ঋষি তাকে সুন্দরভাবে ১৫০ টি পরিচ্ছেদে ভাগ করে তা বিশ্লেষণ করেন।

বাভ্রব্যের বিভিন্ন বিভাগ রচনা

বাভ্রব্য তাঁর গ্রন্থে কামশাস্ত্রকে মোট সাতটি ভাগ করে রচনা করেছিলেন-

১। সাধারণ কথা

২। নর-নারীর যৌনমিলন ও তৃপ্তি।

৩। যুবতী নারীদের কাম জাগরণ।

৪। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দৈহিক আনন্দ।

৫। পরস্ত্রীর সঙ্গে সম্বন্ধ ও পরস্ত্রীর সঙ্গে কাম।

৬। বারাঙ্গনামের কাম বৃত্তান্ত

৭। শারীরিক সৌন্দর্য ও কামশক্তি বৃদ্ধির উপায়।

বাভ্রব্য এইভাবে তাঁর গ্রন্থে কামশক্তিকে একটা সুনির্দিষ্ট পথে চালিত করেন ও তার একটি বিভাগ করে দেন। এই পুস্তক সারা বিশ্বের পণ্ডিত ও লেখক সমাজে বিশেষ প্রশংসা লাভ করে।

বাভ্রব্যের পর কামশাস্ত্র

বাভ্রব্যের গ্রন্থটির বিভিন্ন অধ্যায়কে আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে ভারতের ঋষিরা বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেন।

১। চারায়ণ লেখেন - সাধারণ কাম বিচার।

সুবর্ণাভ নামক লেখক - যৌন কাম বিচার।

৩। ঘোটকমুখ লেখেন - যুবতী নারীর বিচার।

৪। গোমার্দীয় লেখেন - স্বামী-স্ত্রীর সম্বন্ধের বিচার।

৫। গণিকাপুত্র লেখন - পরস্ত্রীগমন বিচার।

৬। দত্তক লেখেন - পতিতাদের কাম বিচার।

৭। কুচুমার লেখেন - দেহ সৌন্দর্য ও যৌনিক বৃদ্ধির উপায় বিচার।

কিন্তু এই সব গ্রন্থ প্রত্যেকটি উৎকৃষ্ট হলেও, পরস্পর পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল বলে লোকের মনকে তা আকর্ষণ করতে পারে নি। তাই ঋষি বাৎস্যায়ন এই শাস্ত্র একত্রিত করে তাঁর কামসূত্রমনামক গ্রন্থটি রচনা করলেন। এই গ্রন্থে তিনি বিভিন্ন ভাগে সব রকম কাম উদ্রেকের তত্ত্ববিষয়ে সুন্দর ভাষায় ও স্পষ্ট করে আলোচনা করেছেন।

কামশাস্ত্রের ধারা

বাৎস্যায়নের কামসূত্রের বাভ্রব্যের মতই সাতটি অংশ। এই গ্রন্থ তিনি ছত্রিশটি অধ্যায়ে ভাগ করেন। মোট ৬৪টি বিষয়ে তিনি এ গ্রন্থের মধ্যে বিশদভাবে আলোচনা করেন। এই গ্রন্থের আলোচনা তিনি সম্পূর্ণ করেন মোট ১২৫০টি শ্লোকের মাধ্যমে। তাঁর শ্লোকগুলি অপূর্ব, প্রতিটি শ্লোকের বক্তব্য এত সুন্দর যে তার ব্যাখ্যা করলে প্রচুর লেখা যায়। কিন্তু আমরা অতি সংক্ষেপে অথচ সুস্পষ্ট ভাবে কি করে তা ব্যাখ্যা করা যায় সেই চেষ্টা করেছি।

বাৎস্যায়ন তাঁর বইতে তৎকালীন সমাজের সুন্দর স্পষ্ট ছবি এঁকে গেছেন। তিনি যে কালে গ্রন্থ রচনা করেন, তখন আমাদের দেশ বাইরের মুসলমান দ্বারা আক্রামণ হয় নি। তাই এ দেশে স্ত্রী-স্বাধীনতা বিদ্যমান ছিল স্ত্রী-পুরুষ স্বাধীনভাবে মেলামেশা করত, এমন কি নানা ঠাট্টা তামাশা বা কৌশলে শ্লোকের মাধ্যমে যৌনতার ইঙ্গিত দেওয়াকে তারা ঘৃণা মনে করত না। সত্যিকারের রুচিজ্ঞান ছিল তাদের মনে।

কামশস্ত্রে সমাজ ব্যবস্থা

বাৎস্যায়নের কামশাস্ত্রে সমাজ ব্যবস্থার বিষয়ে সুন্দর বর্ণনা আছে। পুরুষেরা পুঁথিপাঠ, গ্রন্থরচনা, দেশ-বিদেশে গমন, নানা প্রকার ব্যবসা বাণিজ্য করত আর্থিক, ধর্মবিষয়ক ও সম্ভোগাদি বিষয়ে তারা যথেষ্ট উন্নতি করেছিল। নারীরা, তেমনি স্বাধীনভাবে নানা শিল্পকলা ও সঙ্গীতকলায় পারদর্শিনী হয়ে সংসারের নানাবিধ সুখ সম্পদ উপভোগ করত এইভাবে সুন্দর জীবন তাঁরা উপভোগ করত - জীবনকে প্রকৃত শিল্পকলার মত ভাবে তারা গ্রহণ করত।

বিলাস ব্যসন

সে আমলে দেশের রাজকর্মচারী ও ধনী, অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা নৃত্যগীত ও বিলাস ব্যসনে বেশ সময় কাটাত, এভাবে তারা জীবনকে ভোগ করত। নৃত্যগীত নিপুনা ও বিলাস ব্যসন সংযুক্ত নানা কৃষ্টিসম্পন্ন গণিকা ছিল সে আমলে। তারা অধিকাংশই ছিল সুন্দরী নর্তকী ও গায়িকা। এদের সংস্পর্শে এসে তাঁরা জীবনটিকে ভোগ করত ঠিক ইন্দ্রপুরীর মতজীবনকে ভোগ করত ধর্ম, অর্থ, কামের প্রতীক রূপে। সে এমন একদিন ছিল, যখন পুরুষ ও রমণীর উপভোগে কোন বাধা ছিল না। কামতৃপ্তি ছিল বিরাট বড় বস্তু, তাতে কোন সামাজিক বাধা মাথা তুলতে পারত না।

কামশাস্ত্রে যথেষ্ট সঙ্গম

কামশাস্ত্রে যথেষ্ট সঙ্গম বা ইচ্ছামত নর-নারীর তৃপ্তিকে উচ্চ আসন দেওয়া হয়েছে। তাই তৎকালীন পরিপ্রেক্ষিতেই পরস্ত্রীগমন, পতিতাগমন প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। নারী যেমন খুশিভাবে পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশা ক, তেমন ইচ্ছামত নিজের মনমত পুরুষ উপভোগ করতেও পারত পুরুষ অর্থ ও উচ্চপদের অধিকারী হলে ইচ্ছানুযায়ী নারীকে যথেষ্ট ভো করতে পারত কিন্তু বলপ্রয়োগ ছিল অশাস্ত্রীয়। সে আমলে দরিদ্রা নারী যদি গুণবতী বা রূপবতী হত তা হলে রাজ্যের প্রধান পুরুষকেও ধন্য করতে পারত। যদি কোন পুরুষ বংশদোষে হীনপদস্থ বা অর্থাভাবে পথের কাঙালও হত, তা হলেও শিল্প বা কলার প্রভাবে বা বাণিজ্যের অর্থাগমে রাজ্যের রাজকন্যাকেও শয্যাসঙ্গিনী করতে পারত।

সেকালে ইন্দ্রিয় সেবা, উল্লসিত জীবন ও যৌবন চরিতার্থতা ছিল মানুষের কাম্য পদার্থ। শুধুমাত্র মোক্ষ বা মুক্তির জন্যই মানুষ পাগল ছিল না। ধর্ম, অর্থ, কাম এই তিন বস্তুর জন্যও লালায়িত ছিল আমরা সমাজের এই সব অনেক দৃষ্টান্ত অন্যান্য সংস্কৃত গ্রন্থেও দেখতে পাই।

বাৎস্যায়নের দেশ ও কাল

বাৎস্যায়নের কামসূত্র পড়লে বোঝা যায়, ঐরূপ কাম বিলাস সম্পন্ন পুরুষ ও নারীদের যুগে তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল কোথায় এবং কোন দেশে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন তার ঐতিহাসিক বৃত্তান্ত বিশেষ পাওয়া যায় না। তবে মনে হয়, তিনি গুপ্ত সম্রাটদের সময়েই আবির্ভূত হয়েছিলেন। এই গুপ্ত সম্রাটদের সময়েই মহাকবি কালিদাস, জ্যোতির্বিদ বরাহমিহির ইত্যাদি মনীষি সম্পন্ন ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাৎস্যায়নের সাহিত্যের মত তাঁদের সাহিত্যেও অনেক অধুনা সমাজ বিরুদ্ধ ও তথাকথিত বর্তমান অশ্লীল আখ্যা বিশিষ্ট কবিতাও লেখা দেখতে পাওয়া যায়। নাট্য লেখক শূদ্রক রাজাও ঐ সময়ে তাঁর মৃচ্ছকটিক নামে সংস্কৃত নাটক লেখেন। তবে অনেকে বলেন বাৎস্যায়ন খ্রীষ্টপূর্ব যুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কেউ কেউ বলেন খ্রীষ্ট জন্মের পরবর্তী যুগে তিনি জন্মগ্রহণ করেন দাক্ষিণাত্য দেশে। এ বিষয়ে অনেক মতানৈক্য আছে। তবে আমরা এ কথা অনেকটা বিশ্বাস করি যে মহর্ষি বাৎস্যায়ন গুপ্ত রাজাদিগের সময়েই জন্মগ্রহণ করেছিলে। বহু দেশ-বিদেশ ঘুরে যৌনক্রিয়ার বিভিন্ন প্রচলন দেখে জ্ঞান লাভ করে কামসূত্র নামে এই পুস্তকটি রচনা করেন। তাঁর পুস্তক পড়লে বুঝতে পারা যায় যে তিনি যখন জীবন যাপন করেছিলেন, সেই সময় ভারতের অধিকাংশ লোক গীত, বাদ্য ও নানা কামশাস্ত্রে ব্যুৎপন্ন ছিলেন।

কামসূত্রকালে সামাজিক জীবন

কামসূত্র যে কালে রচিত হয়, সে আমলে লেখাপড়া সাধারণ লোকের মধ্যে খুব বেশি পরিমাণে চালু ছিল স্ত্রী-স্বাধীনতা, স্ত্রীলোকদের আদর-যত্ন করা সমাজে বেশ প্রচলিত ছিল কামশাস্ত্র পাঠ করলে বোঝা যায় তখনকার সমাজের ব্যবস্থা মদ্যপায় নিজেদের একত্র বিহার ও উল্লসিত আচরণ উদ্যান যাত্রা অর্থাৎ বহু প্রস্ফুটিত ও সুগন্ধি পুষ্পদল শোভিত উদ্যান বীথিকায় নর-নারীর একত্রে ভ্রমণ, লেখাপড়া, শিল্প কার্য, বাণিজ্য ইত্যাদি যথেষ্ট উন্নতি লাভ করেছিল তৎকালীন নানা সাহিত্যে, যেমন প্রাচীন নাট্য লেখক কালিদাস প্রভৃতির গ্রন্থে, সেই সমাজের জীবন ধারার অনেক ইতিহাস পড়তে পারা যায় যা বাৎস্যায়ন লিখে গেছেন, তার সঙ্গে এর অনেকটা মিল পাওয়া যায়।

অশ্লীল কথাটায় বহু ব্যাপকতা আজকাল ঘটেছে কিন্তু ঋষি বাৎস্যায়নের সময়ে এই কথাটার এত প্রচলন হয় নি। রসপূর্ণ বাক্য সে আমলে রাজদরবার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সকলের কাছেই ছিল আদরণীয়। অবশ্য বাক্য নগ্ন হত না কিন্তু এমনভাবে তা বলা হত যে তার অর্থ দুভাবে ব্যবহার করা যায়। সে আমলে শালীনতা বোধ ছিল ঠিকই কিন্তু রসবোধ ছিল এবং যৌনতা রস বলে গণ্য হত